বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন ও তার প্রভাব সম্পর্কিত অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলা এবং রায় রয়ছে, যা পরিবেশ সংরক্ষণ এবং জনগণের স্বাস্থ্য রক্ষায় আইনি রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করেছে। এই মামলাগুলোর মাধ্যমে আদালত সরকার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে তাদের পরিবেশগত এবং জলবায়ু সংক্রান্ত দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য করেছে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও দুর্যোগের ক্ষেত্রে বিচার বিভাগ দেশের আইন বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। নিচে বাংলাদেশের কিছু গুরুত্বপূর্ণ জলবায়ু সম্পর্কিত মামলা ও রায় নিয়ে আলোচনা করা হলো-
1. ইস্টার্ন ফার্মাসিউটিক্যালস মামলাটি (২০১০)
এটি বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত মামলা, যেখানে আদালত পোল্ট্রি শিল্পের বিষাক্ত বর্জ্য পরিশোধনের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দিয়ছিল। মামলার মধ্যে উল্লেখ করা হয়ছিল, এই বর্জ্য সরাসরি জলাশয় ফেলা হচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এবং জনস্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আদালত নির্দেশনা দেয় যে, এসব বর্জ্য পরিশোধন করতে হবে এবং আইন অনুযায়ী তা নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
2. বায়ু দূষণ মামলাটি (২০১১)
বাংলাদেশে বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে একটি উল্লেখযোগ্য মামলা ছিল যেখানে আদালত ঢাকার বায়ুদূষণকে জনস্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক হিসেবে ঘোষণা করে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দিয়ছিল। আদালত ঢাকায় বায়ুদূষণ কমানোর জন্য গাড়ির নির্গমন পরীক্ষা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর নীতি গ্রহণের নির্দেশনা দেয়।
এছাড়াও, আদালত নির্দেশনা দেয় যে, ঢাকা শহরে হেভি ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে যাতে বায়ু মান উন্নত হয়।
3. নদী উদ্ধার মামলা (২০১৬)
নদী পুনরুদ্ধারের জন্য ২০১৬ সালে একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা দায়র করা হয়ছিল, যাতে আদালত নির্দেশনা দেয় যে, বাংলাদেশের নদীগুলো রক্ষা ও পুনঃস্থাপন করতে হবে। এই মামলায় নদী দূষণ, ভূমি দখল এবং অবৈধ সয়ল মাইনিংয়র কারণে নদী সংকোচন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় পদক্ষেপ গ্রহণের আদেশ দেয়। আদালত সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নদী পুনরুদ্ধারের জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণের নির্দেশনা দিয়ছিল, যাতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবিলার জন্য উপকূলীয় এলাকায় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।
4. দক্ষিণাঞ্চলে উপকূলীয় বন সংরক্ষণ মামলা (২০১৭)
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রতিরোধে কন্ট্রোল ও সুরক্ষার জন্য একটি উল্লেখযোগ্য মামলা ছিল। এতে আদালত সরকারকে উপকূলীয় বনগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়ছিল। আদালত জানিয়ছে যে, উপকূলীয় বনসমূহ ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে এবং এই বনের ধ্বংস বাংলাদেশের জলবায়ু সুরক্ষা প্রক্রিয়ার জন্য বিপদজনক।
5. সেন্ট্রাল ব্যাংক বনভূমি মামলা (২০২০)
এই মামলায় বাংলাদেশ পরিবেশ আদালত বনভূমির বাণিজ্যিক ব্যবহার, বন উজাড় এবং ভূমি দখলের বিরুদ্ধে একটি রায় দিয়ছিল। আদালত সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত আইন প্রয়োগের নির্দেশ দিয়ছিল। বিশেষভাবে, আদালত রাষ্ট্রীয় বনভূমির সমন্বিত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে সরকারকে নির্দেশ দেয়, যাতে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য প্রভাবিত এলাকায় রক্ষা ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
6. জলবায়ু পরিবর্তনজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় মামলার আদেশ (২০১৯)
২০১৯ সালে বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলায় আদালত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশনা দিয়ছিল। মামলার মধ্যে আদালত সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়কে দেশব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে নতুন স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়ছে, সেগুলো মোকাবিলায় বিশেষ কৌশল গ্রহণ করতে বলেছিল। এর আওতায় ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, কলেরা ইত্যাদি রোগের প্রতিরোধের জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করা হয়।
7. কক্সবাজার উপকূল রক্ষার জন্য রায় (২০২১)
কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকার অবৈধ নির্মাণ কাজ এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি সম্পর্কে একটি মামলা দায়র করা হয়ছিল, যেখানে আদালত উপকূলীয় এলাকা রক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়। আদালত জানিয়ছে, উপকূলীয় অঞ্চল জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে, সেখানে অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধ করা এবং ত্রাণ কাজ চালিয় যাওয়ার জন্য সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশগত সুরক্ষায় আদালতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব মামলা এবং রায় সরকারের জলবায়ু নীতিমালা এবং কার্যক্রমে গতি সঞ্চার করতে সাহায্য করেছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট স্বাস্থ্যঝুঁকি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আইনি বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করেছে।
পরিবেশ সংক্রান্ত মামলাগুলোতে আদালতের রায় পরিবেশ সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে পরিবেশ আদালত আইন, ২০১০ প্রণীত হয়ছে, যা পরিবেশ সংক্রান্ত অপরাধের বিচার ও নিষ্পত্তির জন্য বিশেষায়িত আদালত প্রতিষ্ঠা কর
সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গাছ কাটা ও জমি দখলের অভিযোগে বন বিভাগের চারটি মামলা দায়ের