মানসিক স্বাস্থ্য

ভূমিকা 

মানসিক স্বাস্থ্য বলতে আমরা আমাদের ভাল মানসিক অবস্থা, আবেগ-অনুভূতি, চিন্তা-ভাবনা, সমস্যা সমাধান বা মোকাবিলার সক্ষমতা, সামাজিক সম্পর্ক ও জীবন সম্পর্কে আমাদের বোধগম্যতাকে বুঝিয়ে থাকি। আর মানসিক রোগ বা সমস্যা বলতে বোঝায়, ব্যক্তির মনের এমন সংকটাপন্ন অবস্থা, যা তার চিন্তা, অনুভূতি, আচরণ ও পারস্পারিক সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মানসিক স্বাস্থ্য আমাদের সুস্থতার একটি অবিচ্ছেদ্য অংগ। মানসিক স্বাস্থ্য ভাল না থাকলে সমাজে পূর্ণ সক্ষমতায় অবদান রাখা অসম্ভব। মানসিক অসুস্থতা বিভিন্ন রকমের হতে পারে, যেমন হতাশা, বিষন্নতা, মানসিক অস্থিরতা, মস্তিষ্ক বিকৃতি এমনকি অত্নহত্যার প্রবনতা। 
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে প্রতি লাখ মানুষের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা ২ জনেরও কম। উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে এই সংখ্যা ৬০ জনেরও বেশি। তবে আশার কথা হলো, বিশ্বজুড়ে গড়ে মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। পৃথিবীর স্বাস্থ্যখাতের মোট বাজেটের মাত্র ২ দশমিক ১ ভাগ ব্যয় হয় মানসিক স্বাস্থ্যসেবায়। বিশ্বে শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষের বাস নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। একইভাবে যাদের মানসিক রোগ আছে, তাদের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি লোক এসব দেশের বাসিন্দা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০৩০ সাল নাগাদ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে বিষণ্নতা ব্যাপক আকার নেবে।

 

দেশের সার্বিক পরিস্থিতি

২০১৯ সালের শেষে বিশ্বব্যাপী কোভিড মহামারীর আবির্ভাবের কারণে সারাবিশ্ব একটি প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে অতিবাহিত করেছে যা লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটায় এবং অসুস্থতা নিয়ে আসে। এই মহামারীর আঘাতে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন যারা দরিদ্র, প্রতিবন্ধী, অথবা বিভিন্ন শারীরিক স্বাস্থ্য জটিলতায় আক্রান্ত। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৮-২০১৯ এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক (১৮ বছরের বেশি) মানুষের মধ্যে ১৮ শতাংশের বেশি কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত এবং ১২ দশমিক ৬ শতাংশ কিশোর-কিশোরীর (৭-১৭ বয়সী) মধ্যে মানসিক রোগ শনাক্ত করা গেছে।
দেশে নারীদের মধ্যে প্রতি ৫ জনে ১ জন মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। মানসিক স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আসছেন না ৯১ শতাংশের বেশি মানুষ। অন্যদিকে পুরুষদের মধ্যে মানসিক রোগ নিয়ে বেশি সংস্কার ও নেতিবাচক ধারণা দেখা যায়। এমনকি সমস্যাগ্রস্ত কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য সেবার আওতায় আসার হার ২ শতাংশেরও কম।

 

বর্তমান নীতিমালা সমূহ

মানসিক স্বাস্থ্যনীতি
মানসিক সুস্বাস্থ্য ব্যাক্তিকে তার সম্ভাবনা  ও সক্ষমতাকে বুঝতে সাহায্য করে, দৈনন্দিন চাপ মোকাবেলা করে উৎপাদনশীল কাজের মাধ্যমে সমাজে ভূমিকা রাখতে সক্ষম করে তোলে। মানসিক স্বাস্থ্য নীতিতে আত্মহত্যা প্রবণতা ও ঋুঁকি হ্রাস, ই-মানসিক স্বাস্থ্য সেবা, ব্যাপক প্রচারণা, সচেতনতা কার্যক্রম, তাৎক্ষণিক জরুরি উদ্ধার ব্যবস্থা ও অংশীজনকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাসহ প্রায় ১৫ টি কাজের ক্ষেত্রসমূহ নির্ধারণ করা হয়েছে।
 

বর্তমান আইন সমূহ

মানসিক স্বাস্থ্য আইন ২০১৮
বাংলাদেশ উত্তরাধিকারসূত্রে শুধুমাত্র একটি বিশেষায়িত মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতাল এবং শতাব্দী পুরোনো আইন, লুনাসি অ্যাক্ট ১৯১২ কে পেয়েছিল। অতঃপর জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি ২০১১ প্রণীত হয়েছিল, যেখানে স্বাস্থ্যকে  সম্পূর্ণ শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক সুস্থতা হিসাবে স্বীকৃত দেয়া হয়েছিল। দেশে দ্রুত নগরায়নের ফলে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বেড়ে যাচ্ছে  এ প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে  মানসিক স্বাস্থ্য আইন ২০১৮  প্রণীত হয়েছে।  বিদ্যমান মানসিক আইনটি চিকিৎসা কেন্দ্রেক যেখানে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান সম্পত্তি ও পুনর্বাসনের অধিকার রক্ষা এবং মানসিক ব্যাধি বা অসুস্থতাযুক্ত ব্যক্তিদের সামগ্রিক কল্যাণের বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে । যদিও তা যুগপোযুগী নয় ভবিষ্যতের নীতি সংস্কারের  বিবেচনায়  সীমাবদ্ধতাগুলোকে চিহ্নিত করেতে অন্যান্য কিছু দেশের আইন ও অভিজ্ঞতার বিনিময় করা যায়।
মানসিক স্বাস্থ্য আইন ২০১৮ একটি বিশেষ আইন যা অন্যান্য বিদ্যমান আইনের ওপর প্রভাব ফেলে, এতে চারটি প্রধান বিষয়ের বিধান রয়েছে- (ক) মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতাল এবং পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন এবং তত্ত্বাবধান; (খ) মানসিক স্বাস্থ্য রোগীদের মূল্যায়ন, ভর্তি ও চিকিৎসা; (গ) মানসিক স্বাস্থ্যের বিচার বিভাগীয় পরীক্ষা এবং মানসিক ক্ষমতা নির্ধারণ; এবং (ঘ) এ ধরনের রোগীদের ব্যক্তি এবং সম্পত্তির অভিভাবকত্ব। মানসিক স্বাস্থ্য আইন ২০১৮ কিছু প্রাসঙ্গিক পদকে সংজ্ঞায়িত করে, যেমন চিকিৎসার সম্মতি, মানসিক স্বাস্থ্য, মানসিক ব্যাধি এবং মানসিক অসুস্থতা। ‘চিকিৎসার জন্য সম্মতি’ শব্দটি আলগাভাবে আইনে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এবং মানসিক অসুস্থতা এবং মানসিক ব্যাধির মধ্যে একটি সূক্ষ্ম পার্থক্য তৈরি করা হয়েছে। মানসিক অক্ষমতা, মাদকাসক্তি এবং অন্য কোনো চিকিৎসা গত ভাবে স্বীকৃত মানসিক অবস্থা সহ ‘মানসিক ব্যাধিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়, যা একজন ব্যক্তির শরীর ও মনের সাথে যুক্ত থাকার কারণে তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করে, যেখানে মানসিক অসুস্থতাকে সংজ্ঞায়িত করা হয় মানসিক অক্ষমতা বা মাদকাসক্তি ছাড়া অন্য মানসিক অসুস্থতার রূপ হিসেবে। এ আইনে মানসিক ব্যাধি যুক্ত ব্যক্তিদের মূল্যায়ন, ভর্তি এবং চিকিৎসার জন্য আরও বিশদ প্রক্রিয়া এবং পদ্ধতি বর্ণনা করে।

আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা

মানবাধিকারের প্রধান আন্তর্জাতিক চুক্তি সমূহে মানসিক স্বাস্থ্যকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।   জাতিসংঘ (UN) মানবাধিকার ঘোষণা (1948), নাগরিক রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তি (ICCPR, 1966) এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক সাংস্কৃতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তি (ICESCR, 1966) এগুলোমূলত মানবাধিকারে মুল দলিল। এই উপকরণগুলি বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের জন্য মানবাধিকারের মানদন্ড তৈরি করেছে, যা সকল রাষ্ট্রের জন্য অনুসরণীয়। 

আদালতের মামলা এবং রায়

গবেষণা ও প্রকাশনা

বাংলাদেশসহ ২১টি দেশের শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ইউনিসেফ ও গ্যালাপ পরিচালিত আন্তর্জাতিক এক জরিপের প্রাথমিক ফলের কিছু অংশ ‘দ্য স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ড চিলড্রেন ২০২১’–এ উঠে এসেছে। এতে দেখা গেছে, জরিপে অংশগ্রহণকারী ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে যে অংশ হতাশা বোধ করে বা কিছু করতে তেমন আগ্রহ পায় না, ২১টি দেশের মধ্যে ১৯ শতাংশ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা ১৪ শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশে লাখ লাখ তরুণ জনগোষ্ঠী রয়েছে, যারা নিয়মিত হতাশায় ভোগে বা উৎসাহহীন বোধ করে। অধিকন্তু, বয়ঃসন্ধিকালের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা ও অসুস্থতার বিষয়েও ভাবনার অবকাশ আছে।
কায়িক পরিশ্রম ও শরীরচর্চা​